প্রকাশিত: Sat, Jan 21, 2023 3:04 PM
আপডেট: Sat, Jun 28, 2025 12:05 PM

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমারেখা?

মোজাফ্ফর হোসেন

‘আমি তোমার আদর্শের সাথে দ্বিমত করতে পারি, কিন্তু তোমার বলার স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন দেবো।’-ভলতেয়ারের জীবনীকার ঊাবষুহ ইবধঃৎরপব যধষষ. ‘বাকস্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তচিন্তা’ নিয়ে দ্বিধা আছে গোটা পৃথিবীতেই। হেটস্পিচ কি ফ্রিডম অব স্পিচ বা ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন-এর ভেতর পড়ে? ‘বাকস্বাধীনতা’ থাকলে তো ব্যক্তির সব ধরনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিৎ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেটা কি সম্ভব? বা কতটুকু যৌক্তিক? 

আমি নিজেও দ্বিধান্বিত এই বিষয়ে। পৃথিবীতে ‘ধনংড়ষঁঃব’ বলে কোনোকিছু নেই। তাই মত প্রকাশের ক্ষেত্রেও দধনংড়ষঁঃব ভৎববফড়স’ বা চূড়ান্ত স্বাধীনতা বলে কিছু হতে পারে না। পৃথিবীর কোথাও তা নেই-ও। যে কারণে আমি হেটস্পিচকে বাকস্বাধীনতা বলে মনে করি না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভিত্তিহীন কথা বলে উগ্র মৌলবাদ বা সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়া বাকস্বাধীনতার ভেতর পড়ে না। কেউ যদি এমন বক্তব্য দেন, যাতে দেশের (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে) সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর লোকজন বিপন্নবোধ করেন বা তাদের নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা তৈরি হয়, তবে সেই বক্তব্য অনুমোদনযোগ্য নয়। অর্থাৎ ব্যক্তিক মুক্তমত প্রকাশ যদি গোটা দেশের সাম্য ও সহিঞ্চুতায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তবে সেই ‘মুক্তমতচর্চা’ কোনো অর্থেই ইতিবাচক নয়। 

তবে কি, গোটা সম্প্রদায় যদি মিথ্যা বা ভ্রান্ত বিষয়ের ওপর চলছে বলে মনে হয়, তাহলে কি একজন ব্যক্তি কোনো ‘সত্য’ আবিষ্কার বা উপলব্ধি করতে পারলে সেটি প্রকাশ করতে পারবেন না? বেশ কঠিন প্রশ্ন। কারণ এর সঙ্গে সম্পূরক প্রশ্ন হল, ব্যক্তি যাকে সত্য বলে মনে করছেন, সেটি আদৌতেও সত্য কিনা? নাকি ব্যক্তির বিভ্রান্তি মাত্র? 

সহজ উত্তর আমার জানা নেই। শুধু এটুকু জানি, ঈড়ঢ়বৎহরপঁং যখন পৃথিবীর গোটা বিশ্বাসের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ঃযব ঁহরাবৎংব ঃযধঃ ঢ়ষধপবফ ঃযব ঝঁহ ৎধঃযবৎ ঃযধহ ঃযব ঊধৎঃয ধঃ ঃযব পবহঃবৎ ড়ভ ঃযব ঁহরাবৎংব। কথাটি তারও আগে বলেছিলেন অৎরংঃধৎপযঁং ড়ভ ঝধসড়ং। তাঁদের মত প্রকাশ সাময়িকভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত না হলেও পরে সেটিই ঝপরবহঃরভরপ জবাড়ষঁঃরড়হ-এ বিশেষ অবদান রেখেছে। 

দার্শনিক সক্রেটিস যে জ্ঞানদানের কাজ করেছেন তাতে তাঁর সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ, শাসকগোষ্ঠী খুশি হননি। বিষপানে মৃত্যুদণ্ডে বাধ্য করা হয়েছিল এই মহান-পণ্ডিতকে। খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাস অনুসারে, যিশুখ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার রায় তখনকার রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের বিচারের মাধ্যমে হয়েছিল। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে হিজরতের আগে যে হত্যার সিদ্ধান্ত কোরাইশ নেতারা নিয়েছিল সেটিও ছিল তাদের এক ধরনের বিচারিক সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির মত গোটা গোত্রের বিদ্যমান মতের সঙ্গে মেলেনি। কিন্তু পরবর্তীতে ‘ইতিহাস’ তাদের ‘সত্যের প্রচারক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। 

এ পর্যায়ে বিষয়টা কিছুটা সরল মনে হলেও আদৌতে তা নয়। বৈজ্ঞানিক সত্য আর ভাবাদর্শিক সত্য এক বিষয় নয়। যে কারণে কোপারনিকাসকে গোটা বিশ্ব গ্রহণ করতে পারলেও মুহাম্মদ কিংবা যিশুখ্রিস্টকে গ্রহণ করতে পারেনি। যাকে সত্য বলে প্রচার করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ, তা সর্বজনীন সত্য (ঃৎঁঃয রহ মবহবৎধষ) হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। অর্থাৎ এই সত্যটা একপক্ষীয়। ৬৩০ খৃস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর মুহাম্মদ (সা.) যে কাবাঘরের রক্ষিত হুবালসহ ৩৬০টি মূর্তি সরিয়ে ফেলেন, সেটি মক্কার কুরাইশ বংশের হুবাল অনুসারীগণ স্বাভাবিক ভাবে নিতে পেরেছিলেন? কিংবা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা কিংবা নাসিরনগরে মন্দিরে হামলা নিশ্চয় সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য ঘটনা নয়। 

অর্থাৎ সবমিলে ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীক স্বাধীনতার একটা লিমিট আছে। বাকস্বাধীনতা থাকতে পারে সর্বজনীন সত্য প্রকাশের জন্যেই, যে সত্য গোটা মানবজাতির জন্য সত্য। বাকস্বাধীনতা থাকতে পারে সাম্প্রদায়িক সত্য বলার জন্যও। যেমন—একজন মুসলিম প্রচার করতে পারেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার কথা, একজন হিন্দু প্রচার করতে পারেন দেবতার প্রার্থনার কথা। এক্ষেত্রে নিশ্চয় একজন নাস্তিকও তার অবিশ্বাসের কথা ও যৌক্তিকতা সমাজের সামনে তুলে ধরার অধিকার রাখবেন। এটা তাঁর বাক-স্বাধীনতা। কিন্তু হিন্দু দেব- দেবী বা মুহম্মদ (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করা বাকস্বাধীনতা বলে গণ্য হতে পারে না যতক্ষণ সমাজ সেটা গ্রহণে প্রস্তুত না-হয়। নাস্তিকতার বিরুদ্ধেও বিদ্বেষ ছড়ানো বাকস্বাধীনতা নয়। সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যৌক্তিক বিশ্লেষণ হতে পারে। কেউ-ই কোনো মতাদর্শকে না মানলে সেটি প্রকাশ করতে পারেন। বিদ্বেস আর গঠনমূলক সমালোচনা আলাদা বিষয়। যে কোনো শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতি ও আইনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কথা বলা জনগণের বাকস্বাধীনতা। শিল্পের স্বাধীনতা বনাম শিল্পীর মুক্তি

ছোটবেলার একটা গল্প বলি। আমার সাহিত্যে ঝোঁক দেখে, পাশের গাঁয়ের কুদ্দুস ভাই আমাকে একদিন বললেন, ‘আমার মাথায় দারুণ একটা আইডিয়া আছে’। আমি বললাম, লিখে ফেলেন। তিনি বললেন, ‘থাক, সমাজ নিতে পারবে না’। এরপর ফের একদিন বললেন, ‘হেব্বি একটা গল্প এসেছে মাথায়!’ বললাম, লিখে ফেলেন। বললেন, ‘বিএনপি (তখন ক্ষমতায়) নিতে পারবে না’। এরপর আবার একদিন বললেন, ‘এই গল্পটা লিখতেই হবে!’ বললাম, লেখেন। বললেন ‘থাক। ধর্মপ্রাণ লোকজন নিতে পারবে না।’ আরো বেশ কয়েকবার এরকম বলার পর একবার আমি জোর দিয়ে বললাম, লিখতে আপনাকে হবেই। আমি আর শুনছি না। কে নিতে পারে না পরের হিসাব। তিনি তখন গলা নামিয়ে নরম স্বরে বললেন, ‘ধুর, আমি লিখতে পারি নাকি! লিখতে বসলে খালি বানান ভুল হয়, একটা বাক্যও ঠিক করে লিখতে পারি না।’

মূল কথা এটাই, লিখতে জানতে হয়। লিখতে না জানলে, স্বাধীনতা প্যাকেটে করে বাড়ি গিয়ে জোর করে দিয়ে আসলেও কিচ্ছু হবে না। পৃথিবীর শাশ্বত সত্য হলো: শাসকশ্রেণি সবসময় গলার উপর তলোয়ার রেখে বলে মতপ্রকাশের সমস্ত স্বাধীনতা দেওয়া হলো। কিন্তু এও চিরসত্য, লিখতে জানলে জেলে বসেও সৃষ্টি হয় মহাকাব্য। লেখা হয় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামনা’, অথবা ‘প্রিজন নোট’। কিংবা রচিত ও মঞ্চস্থ হয় ‘কবর’। লিখতে জানতে হয় বলছি এই কারণে যে, এক্ষেত্রে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ভাষ্য লেখার শিল্পটা রপ্ত করতে হয়। বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী উপন্যাস ‘দন কিহোতে’ সার্ভেন্তেস লিখেছিলেন জেলে বসে। এটা সম্পূর্ণ স্যাটায়ার উপন্যাস। আবার মার্গারেট অ্যাটউড ধর্মীয় এবং পলিটিক্যাল এলিগরি (দ্য হ্যান্ডমেইড’স টেল) লিখেছেন সায়েন্স ফিকশনের আদলে। ফ্যান্টাসির আদলে এনিমেল ফার্ম লিখেছেন জর্জ অরওয়েল। ডক্টর জেকিল অ্যান্ড হাইড সরাসরি লিখলে তখনকার ‘মোরাল’ সমাজ নিতে পারত? একি কথা সুইফটের ‘গ্যালিভার্স ট্রাভেলস’-এর ক্ষেত্রেও খাটে। 

এভাবে কৌশলের আশ্রয়ে ‘স্পর্শকাতর’ গল্পটা যেমন বলে ফেলা যায়, তেমনি শিল্পের দিকটাও অক্ষুণ্ণ থাকে। ডকুমেন্ট হয় না, সাহিত্য হয়। যেমন, মেটামরফোসিস গল্পে সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর পোকা না হলেও গল্পটা বলা যেত। কিন্তু এই পোকা হওয়ার বিষয়টি যেমন ‘শিল্প’ তেমন প্রত্যক্ষ বাস্তবতার ‘আড়াল’। এতে গল্পটা আরো আকর্ষণীয় ও বৈশ্বিক হয়েছে। 

এরপরও যদি সমস্যা হয়, হবে। লেখক-শিল্পীদের জীবন যোদ্ধার জীবন। যুদ্ধ করতে নেমে চারিদিকে শত্রুর ভয় বলে অস্ত্র ফেলে সৈনিক পালায় কখনো? বৈজ্ঞানিক এবং চিন্তার জবাড়ষঁঃরড়হসবসময় বাধার মধ্য থেকে তৈরি হয়েছে। কথাটা সম্ভবত, নগুগিই বলেছেন, ‘যে দেশে দেখবেন কারাগারা লেখকশিল্পী নেই, বুঝবেন সে দেশে লেখকশিল্পীরা সঠিক পথে নেই।’ কিন্তু এখানে একটা কথা আছে, লেখক-শিল্পীরা নিজেরাই যদি শিল্পের বা চিন্তার স্বাধীনতা না বোঝেন, তাহলে তার কাছে বাহ্যিক স্বাধীনতাও অর্থহীন। রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা ভেতর থেকে আসে।’ নিজেই নিজের চিন্তার কাছে স্বাধীন না হলে সমাজের সবকিছুর কাছে পরাধীন মনে হওয়া স্বাভাবিক। তাই এই প্রশ্নটা জরুরি: লেখক-শিল্পী-নির্মাতা হিসেবে আপনি আপনার চিন্তার কাছে স্বাধীন তো? 

কোনো লেখকশিল্পী যদি চরম অসৎ আর সুবিধাবাদী হোন, তাহলে সে কি তার চিন্তার স্বাধীনতা বুঝবে?

এদেশে এমন লেখক-শিল্পীকে দেখেছি, যার নিজেরই মুক্তি ঘটেনি, সে কি করে সমাজের মুক্তি ঘটাবে? মনে মনে সাম্প্রদায়িক, সাম্প্রদায়িক ভাষা ও সাহিত্য তৈরি করার জন্য কাজ করে। নারীবিদ্বেষী, ধর্ষণে নারীর পোশাক ও কর্মজীবনের দিকে আঙুল তোলে। মুক্তিযুদ্ধ কিংবা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখতে বললে লেখকের ‘অরাজনৈতিক’ সত্তা নিয়ে জ্ঞান দেন, অথবা, ক্ষমতা কিংবা লেখকখ্যাতির মোহের কাছে বিক্রি হয়ে যান। নিজের বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভয় পান। আমি এমনও লেখক দেখেছি, নিজের পাঁচ বছরের কন্যাকে হিজাব করান, সাঈদিকে চাঁদে দেখার বিষয়ে বয়ান দেন, সে কী করে বুঝবে মুক্তির কথা?

আঁকলেই-লিখলেই-সিনেমা বানালেই তো শিল্পী হলো না। কিন্তু এদেশে এখন সেটাই হয়েছে। নির্বাচন এফডিসির, আর প্রার্থী নায়ক/নায়িকার প্রতিশ্রুতি আধুনিক মসজিদ গড়ে তোলার। সরকারি অনুদানপ্রাপ্তির লোভে মুক্তিযুদ্ধ/বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্ক্রিপ্ট করে মারিংকাটিং করে সিনেমা বানানোর ধান্দা। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আবার জিয়ার উপর স্ক্রিপ্ট নিয়ে ঘুরবে। ইনিয়ে বিনিয়ে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা বলা। না আছে অর্থনৈতিক সততা, না আছে রাজনৈতিক সততা। না আছে জাতীয়তাবোধ। ভণ্ডের দল কোথাকার। তাই এই প্রশ্নটা আমি আরো বেশি করে করি: লেখক-শিল্পী নিজে নিজের চিন্তার জগতে ও জীবনাচরণে স্বাধীন ও সৎ তো? লেখক: কথাসাহিত্যিক